টঙ্গী (গাজীপুর)প্রতিনিধি
দেশের কল্যাণ, দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি কামনায় আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হল তাবলিগ জামাতের তিন দিনের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। রোববার সকাল ১০টায় আখেরি মোনাজাত শুরু হয়ে সকাল ১০টা ২০ মিনিট পর্যন্ত চলে। ২০ মিনিট ব্যাপি আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি মাওলানা জুবায়ের।
আখেরি মোনাজাতে আমিন আমিন ধ্বনিতে কম্পিত হয় পুরো ইজতেমার ময়দান ও আশপাশ। টঙ্গীর তুরাগ তীরে সমবেত হয়ে অশ্রæভেজা চোখে মুসল্লিরা দেশ জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন। ইজতেমা ময়দান ও আশপাশে অবস্থান নিয়ে আল্লাহর দরবারে দুই হাত তুলে প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নার বুক ভাসান মুসল্লিরা। সারা বিশে^র পথভ্রষ্ট মুসলমানের সঠিক পথে চলা এবং তাবলীগের কাজে সবাইকে নিয়োজিত হওয়ার তাওফিক কামনা করে মহান আল্লাহর রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত প্রার্থনা করা হয়। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ কামনায় দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি স্রষ্টার দরবারে কান্নাকাটি করেন। লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় আমিন-আমিন।
এর আগে ফজরের পর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা রবিউল ইসলাম। আর ভারতের আব্দুর রহমান হেদায়তি বয়ান করেন। হেদায়তি বয়ানের পরপরই শুরু হয় আখেরি মোনাজাত।
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির সদস্য প্রকৌশলী মো. মাহফুজ জানান, আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শনিবার রাত থেকেই ইজতেমাস্থল টঙ্গীর তুরাগ নদের তীর অভিমুখে মানুষের ঢল নামে। আজ সকাল ৯টার দিকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। শীত-ধুলো-বালি উপেক্ষা করে ৫-৬ কিলোমিটার দূরে বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, কার, ট্যাক্সি ও অন্যান্য যানবাহন রেখে হেঁটেই মুসুল্লিরা ছুটে আসেন ইজতেমা ময়দানের দিকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে বিমানবন্দর থেকে বোর্ডবাজার-গাজীপুরা-টঙ্গী-আশুলিয়াসহ বিভিন্ন সড়ক মুসুল্লিতে একাকার হয়ে যায়। যে দিকেই চোখ যায় শুধু পাঞ্জাবী-টুপি পড়া মানুষ আর মানুষ।
মোনাজাতে অংশ নিতে ইজতেমার মূল ময়দানে ঢুকতে না পেরে পত্রিকা, পাটি, চট, জায়নামাজ, পলিথিন বিছিয়ে রাস্তায় বসে পডছেন মুসুল্লিরা। অনেকেই আবার মোবাইল ফোনে দূর থেকে মোনাজাতে শরিক হন। আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঢল নামে মুসল্লিদের। ভোগাড়া বাইপাস থেকে ইজতেমা মাঠের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার। এই পুরো জায়গা হেঁটেই মুসল্লিরা রওনা হয়েছেন ইজতেমা মাঠের উদ্দেশে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে।
মূল ইজতেমা ময়দানে নারীদের বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। সে কারণে ময়দানের বাইরে খালি জায়গায়, কলকারখানা ও বসত বাড়ির ছাদসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন বহু নারী।
টঙ্গী শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল চত্বরে অবস্থান নিয়েছেন শতাধিক নারী। সেখানে নরসিংদী থাকা আসা সানোয়ারা বেগম বললেন, শনিবার রাতে তিনি টঙ্গী পৌঁছেছেন। কোথাও স্থান না পেয়ে হাসপাতালের চত্বরে অবস্থান নিয়েছেন।
প্রথম পর্বে ভারত ও পাকিস্তান সহ মরক্কো, ফ্রান্স, মোজাম্বিক, রাশিয়া, জর্দান, দক্ষিণ আফ্রিকা, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, তিউনিশিয়া, যুক্তরাজ্য, ইউক্রেন, আমেরিকা, ফিলিস্তিন, শ্রীলংকা, মিসর, সিরিয়া, বেলজিয়াম, সেনেগাল, জাম্বিয়া, কাতার, মালে, লেবানন, কিরগিজস্তান, নেপাল, ইয়েমেন, কেনিয়া, সুইডিস, ইথিওপিয়া, তুর্কি, মিয়ানমার, ক্যামেরুন ও আইভেরিকোষ্টের প্রায় ৫৫০০ বিদেশী মেহমান বিশ^ ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বিদেশ থেকে আসা অতিথিরা প্রথম পর্ব শেষে ইজতেমাস্থল ত্যাগ করে হাজী ক্যাম্পে অবস্থান করবেন। সেখান থেকে তারা নিজ নিজ গন্তব্যে যাবেন।
মোনাজাতে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ: শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে অবস্থিত পুলিশ ক্যাম্পে প্রথম পর্বের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে শরিক হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক এমপি, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এমপি, গাসিক (ভারপ্রাপ্ত) মেয়র আসাদুর রহমান কিরন, গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম প্রমূখ।
মোনাজাত শেষে বাড়ি ফেরা ও যানজটঃ
আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আশা মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করেন। আগে যাওয়ার জন্য মুসল্লিরা তাড়াহুড়ো শুরু করে। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী- কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাষ্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়ক গুলোতে দীর্ঘ জনজট ও যানজট দেখা দেয়। যানজট নিরসন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়। যানবাহন না পেয়ে অনেক মুসল্লিকে পায়ে হেটে গন্তব্যে রওয়না হতে দেখা যায়।
ইজতেমায় ৮ মুসল্লির মৃত্যুঃ
বৃহস্পতিবার থেকে রোববার দুপুর নাগাদ ময়দানে আট মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। রোববার ভোরে আনিসুর রহমান (৭১) নামে এক মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তিনি ঢাকার বংশালের মৃত ছমির উদ্দিনের ছেলে। তিনি ময়দানের ১৮ ও ১৯নং টয়লেটের জিম্মাদার ছিলেন।রোববার ভোরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ছাড়া ইজতেমা চলাকালে আরও সাত মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন—খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানার মলমলিয়া গ্রামের মোবারক হোসেনের ছেলে মুফাজ্জল হোসেন খান (৭০), চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানা সদরের আব্দুর রশিদের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক (৭০), নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার মাসিমপুর গ্রামের রহমতুল্লাহর ছেলে হাবিবুর রহমান হাবি (৭০), সিলেটের জৈন্তাপুরের নুরুল হক (৬৩), ঢাকার কেরানীগঞ্জের হাবিবুল্লাহ হবি (৬৮), গাজীপুরের ভুরুলিয়ার আবু তৈয়ব ওরফে আবু তালেব (৯০) ও ঢাকার মুন্সীগঞ্জ শ্রীনগরের আক্কাস আলী শিকদার (৫০) মৃত্যুবরণ করেন।
আগামী মঙ্গলবার সকাল ১১ টার মধ্যে মাওলানা জোবায়ের অনুসারী মুসল্লিরা ইজতেমা মাঠ ত্যাগ করবেন। মাঠ বুঝিয়ে দেওয়া হবে প্রশাসনের কাছে। পরে প্রশাসন মাওলানা সাদ অনুসারীদের কাছে ময়দান বুঝিয়ে দেবেন। ২০ জানুয়ারি বাদ ফজর থেকে মাওলানা সাদ অনুসারীদের পরিচালনায় বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে। ২৩ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এ বছরের ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা।