প্রতিনিধি,টঙ্গী (গাজীপুর)
অশ্রæভেজা ফরিয়াদের মধ্য দিয়ে রোববার শেষ হলো ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব।২২ মিনিটের আখরি মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর হেদায়েত, ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহকাল ও পরকালের নাজাত এবং দ্বীনের দাওয়াত সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য দোয়া করা হয়। এছাড়া সব ধরনের গুনাহ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহ কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করা হয়। আখেরি মোনাজাতে নিজের আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য দুই হাত তুলে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় উপস্থিত লাখ লাখ মুসল্লি প্রার্থনা করেন। এই মোনাজাতে দুই হাত উপরে তুলে লাখ মুসল্লি বারবার বলছিলেন, আমিন আমিন। গতকাল রোববার সকাল ৯টা ১ মিনিটে আখেরী মোনাজাত শুরু হয়। শেষ হয় ৯টা ২৩ মিনিটে।২২মিনিট ব্যাপি মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা জুবায়ের। মোনাজাতে আমিন আমিন ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে টঙ্গীর তুরাগ তীর ও ইজতেমা ময়দানের আশপাশ এলাকা। এ সময় অনেক মুসল্লি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।আখেরী মোনাজাতের আগে বাদ ফজর নামাজের পর হেদায়েতি বয়ান করা হয়। বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল। এরপর কিছু সময় নসিহত মূলক বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলা। এরপর আখেরী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।এ সময় পুরো ইজতেমা মাঠসহ আশপাশ এলাকার পরিবেশে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মহামহিমা ও দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দরবারে অপার করুণা ও অশেষ রহমত কামনা করেন। মনিব-ভৃত্য, ধনী-গরিব নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন।
দক্ষিণে খিলক্ষেত, উত্তরে গাজীপুর চৌরাস্তা, পূর্বে টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরী ও পশ্চিমে আশুলিয়া পর্যন্ত প্রায় ১৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিস্তৃত বিশাল জনসমুদ্র থেকে ধ্বনি ওঠে ‘হে আল্লাহ, হে আল্লাহ’। মোবাইল ফোনে এবং স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তুলেছেন আল্লাহর কাছে। সবাই প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চেয়ে কান্নায় বুক ভাসিয়েছেন। দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লি ছাড়াও বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশের প্রায় ৩ হাজার বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
মুসল্লিদের জন্য বিশেষ ট্রেন: ইজতেমায় আসা মুসল্লিদের যাতায়াতের সুবিধার্তে ঢাকা-টঙ্গী-ঢাকা এবং টঙ্গী থেকে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে যাতায়াতের জন্য ১১ জোড়া বিশেষ ট্রেন চালু রেখেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
এদিকে ইজতেমা ময়দানের মুসল্লিদের যাতায়াত সহজ করতে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে শনিবার রাত ১০টা থেকে গাজীপুরের তিনটি সড়কে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। সড়ক তিনটি হলো, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের ভোগড়া বাইপাস, টঙ্গী-ঘোড়াশাল আঞ্চলিক সড়কের মিরের বাজার থেকে টঙ্গীর স্টেশন রোড পর্যন্ত এবং রাজধানী ঢাকার কামারপাড়া মোড় থেকে টঙ্গীর মন্নুগেট সড়ক।
সকাল সাড়ে ৯টায় আখেরি মোনাজাত শেষে সবাই ফিরতি পথ ধরেন। রাস্তা বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটেই তাদের রওনা হতে হয়।
পুলিশের ট্রাফিক গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজুর রহমান বলেন, “ঢাকামুখী রাস্তাগুলোতে স্রোতের মত মানুষ হাঁটছে। তাই আমরা এসব সড়কে যাত্রীবাহী যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছি। এর মধ্যেই কিছু ছোট যানবাহন ছাড়া হচ্ছে। রোববার দুপুর ২টার পর সড়কগুলো আবার খুলে দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতে এবার বিপুল সংখ্যক নারী অংশ নিয়েছেন। ইজতেমায় নারীদের অংশ নেওয়ার কোনো বিধান না থাকলেও আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েক হাজার নারী শনিবার রাত থেকেই আসতে শুরু করেন। তারা ইজতেমা ময়দানের আশপাশ, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়ি ও বিভিন্ন দালানের ছাদে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।
রোববার ভোর থেকে নারীরা ইজতেমা ময়দানের পাশে টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল মাঠ, ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ও আশপাশের খোলা ময়দানে অবস্থান নেন। আখেরি মোনাজাতের ফজিলত লাভের আশায় তারা মোনাজাতে শরিক হতেই ময়দানের আশপাশের এলাকায় পর্দার সঙ্গে অবস্থান নেন।
টঙ্গী এরশাদ নগর এলাকার বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, বিশ্ব ইজতেমায় নারীদের অংশগ্রহণ না থাকলেও আমরা পর্দার সঙ্গে লাখ লাখ মুসিল্লদের সঙ্গে আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে এসেছি। আল্লার কাছে নিজের, পরিবারের ও দেশের কল্যাণ কামনা করেছি।
১৯ মুসল্লির মৃত্যু: বিশ^ইজতেমায় গতকাল রোববার পর্ষন্ত ১৯মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
তারা হলেন রাজবাড়ী জেলার পাংশা থানার সানোয়ার হোসেন (৬০), চট্টগ্রামের আনোয়ারার জলিলের ছেলে আলম (৫৬), নরসিংদীর নুরুল ইসলামের ছেলে শাহনেওয়াজ (৬০), সিরাজগঞ্জ জেলার ওসমান গনির ছেলে আল মাহমুদ (৭০), শেরপুর জেলা সদরের জুগনিবাগ গ্রামের মৃত শমসের আলীর ছেলে নওশের আলী (৬৫), ভোলা জেলার পরাগগঞ্জ থানার সামানদার গ্রামের বেলায়েত হোসেনের ছেলে আ. কাদের (৫৫), নেত্রকোনা সদরের কালিয়াঝুড়ি এলাকার হোসেন আহম্মদের ছেলে স্বাধীন (৪৫), নেত্রকোনা সদরের কুমারী বাজার গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে আবদুস সাত্তার (৭০), একই জেলার বুড়িঝুড়ি গ্রামের স্বল্পদুগিয়া গ্রামের আব্দুস ছোবাহানের ছেলে এখলাস মিয়া (৬৮), ভোলা জেলার ভোল্লা গ্রামের নজির আহমেদের ছেলে শাহ আলম (৬০), জামালপুর জেলার তুলশীপুর এলাকার পাকুল্লা গ্রামের হযরত আলীর ছেলে মতিউর রহমান (৬০), টঙ্গীর বসির মিয়ার ছেলে আ. জব্বার(৫৫)। আরেকজনের পরিচয় জানা যায়নি।
ময়দানে আসার সময় মারা যাওয়া ছয়জন হলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল থানার ধামাউরা গ্রামের ইউনুছ মিয়া (৬০), চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানার চৌহদ্দীটোলা গ্রামের জামান মিয়া (৪০), পুলিশ সদস্য হাসানুজ্জামান (৩০), শেরপুরের আমেলা খাতুন (৬০), ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা মোশাররফ আহমেদের ছেলে মোবাশ্বের আহমেদ (৬৮) ও আরেকজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত রোববার শেষ হয়েছে এরপর চার দিন বিরতির পর ৯ ফেব্রæয়ারি দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে, ১১ ফেব্রæয়ারি আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।