শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ছয়দিনে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে দফায় দফায় ব্যাপক সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় শিক্ষার্থী, পুলিশ ও পথচারীসহ এখন পর্যন্ত ১৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দেশের কয়েকটি গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে। আহতের সংখ্যা বলা হয়েছে দুই সহস্রাধিক। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানানো হয়নি।
পত্রিকাগুলোকে সূত্র ধরে তারিখ অনুযায়ী সেসব খবরের কিছু কিছু এখানে তুলে ধরা হলো।
১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার
আন্দোলনকারীরা এদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালান। বহু সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হয়। বাংলাদেশ টেলিভিশন, উত্তরা পূর্ব থানা, মেট্রোরেল স্টেশন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দপ্তর, ডাটা সেন্টারসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
বহু শিক্ষার্থী মারা গেছে দাবি করে পরদিন শুক্রবারও কমপ্লিট শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
১৯ জুলাই, শুক্রবার
কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচির ২য় দিন ছিল শুক্রবার। এদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গুলি ও সংঘর্ষে অন্তত ৪৪ জন নিহত হন বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য প্রকাশ করে কয়েকটি পত্রিকা। আর সারা দেশে নিহতের সংখ্যা বলা হয় ৫৬ জন। যদিও পরে হতাহতের সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে এর পরের দিনের পত্রিকায় জানানো হয়। হতাহতদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক, পথচারীসহ অনেক সাধারণ মানুষ। এদিন আহত হন আরও কয়েকশ মানুষ।
দুপুরের পর এদিন রাজধানীর বিআরটিএ কার্যালয়সহ বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিনও মেট্রোরেলের কয়েকটি স্টেশন হামলা-ভাঙচুরের শিকার হয়। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এলিভেডেট এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা। এছাড়া পিবিআই-এর বনশ্রী ও নারায়ণগঞ্জ শাখায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
নরসিংদীর জেলা কারাগারে নজিরবিহীন হামলা চালিয়ে সেদিন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। পালিয়ে যায় ৮ শতাধিক আসামি। লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে বিএনপি-জামায়াত ও জঙ্গিরা এসব নাশকতার ঘটনা ঘটিয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুক্রবারই সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী।
শুক্রবার রাতে আন্দোলনকারীরা ৯ দফা দাবি পেশ করেন। এসব দাবি না মানা পর্যন্ত ‘শাটডাউন’ চলবে বলে জানানো হয়। (তবে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর শিক্ষার্থীরা টিভি মিডিয়ায় ৮ দফা দাবি উত্থাপন করেন)
রাতে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়।
২০ জুলাই, শনিবার
প্রথম দিকে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ হয়, পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশ। ভাঙচুর-সংঘর্ষে টালমাটাল পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশের সঙ্গে মাঠে নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। তাতেও পরিস্থিতি দিন দিন বেসামাল হয়ে পড়ছিল। সেই অবস্থায় জারি করা হয় কারফিউ। রাতারাতি মাঠে নামে সেনাবাহিনী। তারপরও বিক্ষোভ দমানো যায়নি। পথে পথে সেনাসদস্যদের টহলের পরও শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে এবং ঢাকার বাইরে কয়েক জায়গায় ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে প্রাণহানি হয়েছে ৪৫ জনের মতো।
রামপুরা-বাড্ডা এদিনও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ চলছিল। তবে এবার পুলিশের সঙ্গে মাঠে ছিল সেনাবাহিনীও। বিক্ষোভকারীরা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর উদ্দেশে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সড়কে আগুন জ্বালিয়ে স্লোগান দেয়। তাদের লক্ষ্য করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালান। দিনভর দফায় দফায় এ সংঘর্ষ চলতে থাকে। রামপুরার মতো যাত্রাবাড়ীর শনির আখড়া ও কদমতলীর অবস্থাও ছিল একই রকম।
ঢাকার বাইরের পরিস্থিতিও প্রায় একই রকম ছিল। টঙ্গীতে শিল্প পুলিশের কার্যালয়, পুলিশ বক্স এবং বিআরটিএ প্রকল্পের চলন্ত সিঁড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া টঙ্গী থানা এবং সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে তারা। সিটি করপোরেশনের ১১টি গাড়িসহ প্রায় ৪০টি গাড়িতে ভাঙচুর ও আগুন দেয় বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া চেরাগ আলী এলাকায় বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কারখানায় হামলা চালিয়ে তিনটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেওয়া হয়।
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পুলিশের গুলিতে বিক্ষোভরত তিন শিক্ষার্থী নিহত হন। দুপুর ১২টার দিকে কলতাপাড়া এলাকার ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। পুলিশ বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। গাজীপুর-ময়মনসিংহ ছাড়া আরও কয়েক জেলায় ভাঙচুর চালানো হয়। সেখানেও তাদের সংঘর্ষ হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে।
এদিন সরকার পরের ২ দিনের জন্য সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।
২১ জুলাই, রোববার
কোটা পুনর্বহাল-সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল (রদ ও রহিত) করে আপিল বিভাগ রায় প্রদান করেন। রায়ের একটি অংশে কোটা কত শতাংশ রাখা যায় সে বিষয়ে সরকারকে নির্দেশনা দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।
এতে বলা হয়, মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ শতাংশ; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হলো। তবে নির্ধারিত কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কোটার শূন্য পদগুলো সাধারণ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করতে হবে।
এই নির্দেশনার আলোকে সরকারের নির্বাহী বিভাগকে অনতিবিলম্বে প্রজ্ঞাপন জারি করতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
রায়ে বলা হয়, এই নির্দেশনা ও আদেশ সত্ত্বেও সরকার প্রয়োজনে ও সার্বিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোটা বাতিল, সংশোধন বা সংস্কার করতে পারবে।
এদিন পত্রিকাগুলো খবর প্রকাশ করে পাঁচ দিনের সহিংসতায় মৃত্যু বেড়ে ১৭০ জনে দাঁড়িয়েছে। আহত অনেকের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হওয়ায় এবং আগের কয়েকদিনের আরও কিছু মৃত্যুর সংবাদ নিশ্চিত হওয়ার কারণে নিহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে জানানো হয়। সাংবাদিকদের হিসাবে সহিংসতায় মঙ্গলবার ৬ জন, বৃহস্পতিবার ৪৪ জন, শুক্রবার ৭৫ জন, শনিবার ২৬ জন এবং রোববার ১৯ জন নিহত হন।
একই দিন বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৫৬ সমন্বয়কের যৌথ বিবৃতি’ শিরোনামে একটি খুদে বার্তা গণমাধ্যমকর্মীদের পাঠানো হয়। যৌথ বিবৃতিতে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ (সর্বাত্মক অবরোধ) কর্মসূচি আরও জোরদার করার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, শুধু আদালতের রায়ের মাধ্যমে হত্যার দায় এড়াতে পারে না সরকার। বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সরকার সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ‘তিন শতাধিক’ ছাত্র-জনতাকে হত্যা করার অভিযোগ করা হয় তাদের বিবৃতিতে।
এছাড়া বিবৃতিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম সারির কয়েকজন সমন্বয়ককে পুলিশি হেফাজতে নিয়ে মনগড়া বক্তব্য আদায়ের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়েছে। এছাড়া সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদারসহ কয়েকজনের সন্ধান দাবি করা হয়।
২২ জুলাই, সোমবার
এদিন কোটা সংস্কার করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তৈরি করা প্রজ্ঞাপনে অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী।
সংঘর্ষে সারা দেশের আরও ১৩ জন নিহতের খবর পাওয়া যায় সোমবার। তাদের মধ্যে পাঁচজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। নারায়ণগঞ্জে তিনজন মারা যান শনিবার, যাদের লাশ উদ্ধার করা হয় সোমবার। এর বাইরে একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর তথ্য জানা যায় এদিন।
২৩ জুলাই, মঙ্গলবার
কোটাপ্রথা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
মঙ্গলবার পর্যন্ত ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষে মোট ১৯৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে কয়েকটি পত্রিকা। মৃত্যুর এই হিসাব বিভিন্ন হাসপাতাল সূত্র এবং মরদেহ নিয়ে আসা ব্যক্তি ও স্বজনদের সূত্রে পাওয়া। সব হাসপাতালের চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া (২২)। তিনি গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামে গুলিবিদ্ধ হন।
মঙ্গলবার নতুন করে জানা যায় আরও আটটি মৃত্যুর তথ্য। এর মধ্যে ঢাকার ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হাসপাতালে পাঁচজন এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজনের মৃত্যু হয়। সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হয় আরেক ব্যক্তির।
সোমবার ও মঙ্গলবার সারা দেশে ব্যাপক ধরপাকড় চালায় পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় ঢাকাসহ সারাদেশে কয়েক সহস্রাধিক ব্যক্তিকে আটক ও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের বড় অংশই বিএনপি, জামায়াত শিবির ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী। এরা সবাই নাশকতা ও সহিংসতায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করছে পুলিশ।