দফায় দফায় বিমান হামলা আর পদাতিক বাহিনীর আর্টিলারি শেলে ধুলোয় মিশে যাচ্ছে ফিলিস্তিনের ছোট্ট জেনপদ গাজা। ২৩ লাখ মানুষের অবরুদ্ধ বসতি। পৃথিবীর ইতহাসের সবচেয়ে বড় ‘উন্মুক্ত কারাগার’। সেই বন্দীশালাতেই নিরীহ-নিরস্ত্র-কয়েদিদের উপর ফুঁসে উঠেছে ইসরাইলের দানব বাহিনী। স্বাধীন ভূখন্ডের দাবিতে বন্দী গাজা এখন মৃত্যুপুরী।
প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যুতেও পিপাসা মিটছে না মধ্যপ্রাচ্যের ভূখন্ডগ্রাসী এ ভয়ংকর হায়নার। গত ১৩ দিনে ৩ হাজার ৭৮৫ জনকে হত্যা করেছে ইসরাইল বাহিনী। এর মধ্যে ১ হাজার ৫২৪ জনই শিশু! নারী ১ হাজার, বয়স্ক ১২০ জন। আজও হামলা হবে। আরও মরবে। রাত পোহাতে পোহাতে হয়ত দ্বিগুন হবে এ সংখ্যা।
বিষ্ময়টা এখানেই! গাজায় এত মৃত্যুতেও চোখ খুলছে না আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি)। মাত্র ১৩ দিনে নৃশংস হামলা চালিয়েও এখনও যুদ্ধাপরাধি নয় ইসরাইল! লোমহর্ষক এ হত্যাযজ্ঞে পুরো পৃথিবী কাঁদছে- অথচ এখনও একটি লাশও দেখতে পাচ্ছে না আইসিসি। বধির হয়ে গেছে বাতাসে ভেসে বেড়ানো অসহায় মানুষ গুলোর গগনবিদারি চিৎকারও কানে ঢুকছে না আইসিসিরি! গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে এখনো কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয় নি আইসিসি। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের সময় বেশ সোচ্চার ছিলেন আইসিসি’র প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান। গর্জে উঠেছিলেন একেবারে। আক্রমণের মাত্র চার দিনের মাথায় ঘোষনা দিয়েছিলেন ইউক্রেনের ভূখণ্ডে সংঘটিত সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ তদন্ত শুরু করবে আইসিসি। তার কয়েকমাস পরেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছিল আইসিসি। রাশিয়া জোরপূর্বক ইউক্রেনের শিশুদের অপহরণ করেছে বলে অভিযোগ এনছিল তার বিরুদ্ধে। পুতিনের কমিশনার মারিয়া লভোভা-বেলোভার জন্যও ওয়ারেন্ট জারি করে। রাশিয়ার এই ঘৃন্য অপরাধকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেছিল তদন্তকারীরা । রাশিয়ার বেলায় আইসিসি এমন কঠিন পদক্ষেপ নিলেও ইসরাইলের বেলায় সংস্থাটির অবস্থান নমনীয়।
জেনেভা – ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর জানিয়েছে, ইসরাইলের সেনাবাহিনী গাজার নির্দোষ শিশুদের হত্যা করছে। গত ৭ই অক্টোবর হামলার পর থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০০ শিশুকে হত্যা করছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রনায়লের মুখপাত্র আশরাফ আল কুদরা বলেছেন, ইসরাইলের বিমান হামলায় প্রায় ১,৩০০ মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা ৬০০ জন। গাজায় নারী-শিশু হত্যা, বেসামরিক ভবন আর হাসপাতালে ইসরাইলের হামলা স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এরপরও চুপ আইসিসি। অথচ মানবতা বাঁচিয়ে রাখার সব আন্তর্জাতিক আইনের সীমাও ছাড়িয়ে গেছে ইসরাইল।
আন্তর্জাতিক আইনগুলোতে যুদ্ধরত পক্ষগুলো চাইলেই শত্রুপক্ষের যে কারও ওপর হামলা চালাতে ও হত্যা করতে পারে না। যদি কোনো হামলায় বেসামরিক মানুষের জীবনের ক্ষতি সামরিক অর্জনের চেয়ে বেশি হয় তাহলে সেটাকে আইনের লঙ্ঘন বিবেচনা করা হবে।
যুদ্ধকালে জেনেভা কনভেনশন কার্যকর থাকে। এই আইনে যুদ্ধের নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। জেনেভা কনভেনশনে সাক্ষরকারী দেশ ইসরাইল। তাই এইদেশটিও আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য। জেনেভা কনভেনশনের ৪ ধারায় পরিস্কার ভাবে লেখা আছে, হাসপাতালে হামলা যুদ্ধাপরাধ হিসাবে বিবেচ্য।
হেগ কনভেশনের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদেও বলা হয়েছে, হাসপাতাল ও যেসব ভবনে আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিরা আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে অবরোধ ও বোমাবর্ষণের সময় সেসব ভবন এড়িয়ে যেতে হবে, রক্ষা করতে হবে। ইসরাইল এই কনভেনশনের অনুমোদন না করলেও আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন অনুযায়ী, এই দেশটিও বিধান মেনে চলতে বাধ্য। তবে ইসরাইল-গাজা যুদ্ধের বিষয়ে করিম খান মুখ খুলেছেন গত সপ্তাহে। রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে আইসিসির এখতিয়ার রয়েছে।