প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের ক্লিন এনার্জির মূল মেরুদণ্ড হবে নিউক্লিয়ার। নিউক্লিয়ারে ছোট ছোট মডিউলার রিয়াক্টর আসছে, তেলভিত্তিক ছোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো নিউক্লিয়ার দিয়ে রিপ্লেস করা যেতে পারে।
শনিবার বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিপিএমআই) আয়োজিত ‘নতুন বিকল্প জ্বালানি ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ’ চ্যালেঞ্জ শীর্ষক ওয়েবিনারে তিনি এ কথা বলেন।
ড. তৌফিক ই ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার এলে ক্লিন এনার্জির শেয়ার অনেক বেড়ে যাবে। দীর্ঘমেয়াদে নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, সেগুলো নিউক্লিয়ার দিয়ে রিপ্লেস করা ভালো সমাধান হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের যেহেতু জমির সংকট রয়েছে। তাই নদী, জলাশয়ের ওপর সৌর বিদ্যুৎ করতে পারি, প্যানেলগুলো যদি দাম বেশি না হয়। সেটি হতে পারে আমাদের জন্য ভালো সমাধান। যানবাহন হয়তো সহজ হতে পারে। আমাদের ১-২ মিলিয়ন থ্রি হুইলারকে আধুনিকায়ন করার বিষয়ে কাজ করছি।’
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান বলেন, ‘জ্বালানি সংকট নিয়ে প্রতিদিনেই মিডিয়াসহ বিভিন্ন জনের নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিশ্বায়নের নতুন পরিস্থিতির মধ্যে পশ্চিমা বিশ্বের চেয়ে আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে জ্বালানি বিভাগের চেয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের বেশি কাজের সুযোগ রয়েছে।’
বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘ওখানে কোনোদিনেই পুরোপুরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ড মাইনিংয়ে অল্প পরিমান কয়লা তুলতে পারছি। খাদ্য নিরাপত্তা সবার আগে তাই উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যাওয়া সম্ভব না। তাহলে এখানকার কয়লা শেষ হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাগ্য কী হবে? আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে চালানো সম্ভব না। তাহলে কেনো আমরা এটি এখানে করলাম, আমার মনে হয় সমন্বয় করে করলে ভালো হতো।’
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, ‘হাইড্রোজেন নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। আমি মনে করি, সেই দিন বেশি দূরে নয় যেদিন হাইড্রোজেন অন্যতম জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে। আমাদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের প্যাটান ভিন্ন, যখন সোলার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি তখন থাকে চাহিদা কম। আবার যখন সোলার থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় তখন চাহিদা বেড়ে যায়। তাই স্টোরেজ কিভাবে সাশ্রয়ী করা যায় সেটা জরুরি।’
হাইড্রোজেন এনার্জি গবেষণাগার প্রকল্পের পরিচালক ড. আব্দুস সালাম বলেন, ‘বাংলাদেশে বায়োমাস থেকে ক্ষুদ্র আকারে হাউড্রোজেন উৎপাদন হচ্ছে। আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেটায় ২০২২ সালের মধ্যে দৈনিক ৫ কেজি উৎপাদনের লক্ষ্যে কাজ করছি। টেকনোলজি ডেভেলপমেন্টের কাজ চলছে, তবে আমরা এখনও মার্কেটে যেতে পারিনি। আমাদের দেশে যানবাহনে হাইড্রোজেন ব্যবহার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা মনে করছি, প্রতি কিলোমিটারে ৮ টাকার মতো খরচ পড়বে।’
বাংলাদেশ বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘আমরা নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাজ করছি তবে সেভাবে সফলকাম হতে পারছি না। প্রযুক্তির সঙ্গে থেকে উন্নত দেশের পথে হাঁটতে হবে। সোলারের বড় সমস্যা স্টোরেজ না থাকায় রাতের জন্য সমপরিমান বিদ্যুৎ রিজার্ভ রাখতে হচ্ছে। তবে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি চলছে, আশা করছি ভালো কিছু পাওয়া সম্ভব।’
বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দীন বলেন, ‘বাংলাদেশ হাইড্রোজেনে একেবারে পেছনে পড়ে নেই। বিসিএসআইআর একটি প্রকল্প নিয়েছে ২০২২ সালের মধ্যে হাইড্রোজেন সামনে নিয়ে আসবে। সেজন্য গবেষণা করছে।’
হাইড্রো কার্বন ইউনিটের মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘একক কোনো এনার্জির ওপর নির্ভরশীলতার সুখকর হতে পারে না। সম্ভাব্য সব বিকল্প নিয়ে কাজ চলছে। হাইড্রোজেন ভালো সোর্স হতে পারে। রান্না এবং যানবাহনে হাইড্রোজেনকে কাজে লাগাতে পারি।’
আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ খন্দকার সালেক সুফী বলেন, ‘বিশ্বের জ্বালানি মার্কেটে আগুন ধরেছে। কেনো হলো এই পরিস্থিতি, পোস্ট কোভিড ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়েছে, অনেকে কয়লা এবং অন্যান্য সোর্স থেকে সরে আসায় এই অবস্থা হয়েছে। এই অবস্থা আরও কিছুদিন থাকবে। বাংলাদেশের অফসোরে হাইড্রোজেন অনেক সম্ভাবনা রয়েছে।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অস্টেলিয়া প্রবাসী গবেষক অধ্যাপক নওশাদ হক। তিনি বলেন, ‘সোলার যখন শুরু হয় তখন প্রতি মেগাওয়াটে খরচ হতো ৩৫৯ ডলার, এখন খরচ ৩৭ ডলারের নেমে এসেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি এক সময় সাশ্রয়ী হবে তবে তার জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন হবে। কার্বন ইমিশন কমানো এখন প্রত্যেকটি দেশের জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। আমার মনে হয়, একটি নির্দিষ্ট এনার্জির মাধ্যমে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব না, বিভিন্ন সোর্স ব্যবহার থাকা উচিত।’
বিপিএমআইর রেক্টর মাহবুব উল আলম সভাপতিত্ব করেন। তিনি বলেন, ‘গ্রিন এনার্জি ফান্ড থেকে যদি অর্থায়ন করা যায় তাহলে হাইড্রোজেন এনার্জি সহায়ক হতে পারে। আমরা করতে পারবো কী পারবো না সেটি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। সেমিনারটি চিন্তা-চেতনার জায়গা প্রসারিত করবে বলে আমার বিশ্বাস।’
পরিচালক রফিকুল ইসলামের পরিচালনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- স্রেডার চেয়ারম্যান ড. আলাউদ্দিন, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক ড. শৌকত আকবর, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এসএম আলমগীর কবীর, ইপিআরসির চেয়ারম্যান সত্যজিৎ কর্মকার প্রমুখ।