টঙ্গী (গাজীপুর)প্রতিনিধি
মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ তাবলীগ জামায়াতের ৫৭তম বিশ^ ইজতেমা গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর আম বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বিশ্ব ইজতেমায় লাখো মুসল্লীদের অংশগ্রহণে গতকাল শুক্রবার বৃহত্তম জুম্মার নামাজ আদায় হয়েছে। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে টঙ্গীর তুরাগ তীর। ১ম পর্বে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা। গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর নামাজের পর বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা আহমদ বাট। সকাল ১০টা থেকে তালিম করেন পাকিস্তানের মাওলানা জিয়াউল হক। দুপুর পৌনে ২টায় জুমার নামাজ শুরু হয়। নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা জুবায়ের। জুমার নামাজে খুতবা পাঠ শুরু হয় দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে। ইজতেমার ময়দানের মুসল্লি ছাড়াও জুমার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা-গাজীপুরসহ আশপাশের এলাকার হাজার হাজার মুসল্লি ইজতেমাস্থলে এসে হাজির হন। শীত উপেক্ষা করে ভোর থেকেই বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে হাজার হাজার মুসল্লি জড়ো হন। শুকনো খাবার, পানি, বিছানাসহ বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে মুসল্লিরা সারিবদ্ধভাবে ছুটতে থাকেন টঙ্গীর তুরাগ তীরের ইজতেমা ময়দানের দিকে। জুমার নামাজের আগেই ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে। জুমার নামাজে অংশ নেন লাখো মুসল্লি। এ সময় ইজতেমার ময়দান ছাড়িয়ে আশপাশের সড়কগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন মুসল্লিরা। ইজতেমা ময়দানে স্থান না পেয়ে অনেকে বিভিন্ন ভবনের ছাদে নামাজ আদায় করেন। জুমার নামাজের সময় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের পক্ষ থেকেও সড়কটি নামাজের সময় বন্ধ রাখার কথা জানানো হয়। নামাজের পর পুনরায় যান চলাচল শুরু হয়। তবে মুসল্লিদের ভিড়ের কারণে খুবই ধীর গতিতে চলছে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন। যে যেখানে পারছে সেখানেই বসে পড়ছে জুমার নামাজ আদায় করার জন্য।
বিশ্ব ইজতেমা সৌভ্রাতৃত্ব প্রসারে সহায়ক হোক: দেশ-বিদেশের আলেমরা তাদের বয়ানে ইসলামের মর্মবাণী তথা মানবিক আদর্শ ও ভ্রাতৃত্ববোধের দিকগুলো তুলে ধরেন। বিশ্ব ইজতেমায় প্রতিবছর তাবলিগ জামাতের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা একত্রিত হন। পারস্পরিক ভাব ও ধর্মীয় জ্ঞান বিনিময় করেন। তবে সময়ের পরিক্রমায় বিশ্ব ইজতেমা বর্তমানে আর তাবলিগ কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইজতেমা আজ পরিণত হয়েছে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানের মহাসমাবেশে।স্মরণ করা যেতে পারে, প্রায় অর্ধশত বছর আগে দিল্লির কাছে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) মাজারসংলগ্ন মসজিদকে কেন্দ্র করে মওলানা ইলিয়াস (রহ.) মাত্র কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে শুরু করেছিলেন তাবলিগ বা ইসলাম প্রচারের কাজ। এভাবেই গোড়াপত্তন হয়েছিল তাবলিগ জামাতের। আজ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র এর কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগাড় গ্রাম সন্নিহিত মাঠে যে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়, তাতে বিদেশ থেকে তাবলিগ জামাতের অনেক অনুসারী অংশগ্রহণ করেছিলেন। তখন থেকেই এটি বিশ্ব ইজতেমা নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময় থেকে নিয়মিত ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে।দেশে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের ফলে ইসলাম ধর্মের অনেক মৌলিক শিক্ষা সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। ঈমান, আমল, আখলাক ও ইলম অর্জন এবং আত্মশুদ্ধিতে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বিদেশী মেহমান: গত বৃহস্পতিবার রাত ৯টা পর্যন্ত বিশ্বের ৪৩টি দেশের এক হাজার ৫৬৯ জন বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন। ৪৩টি দেশের মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, কুয়েত, সৌদি আরব, আফগানিস্তান, জাপান, ওমান, কানাডা, মোজাম্বিক, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কিরগিজস্তান, সিঙ্গাপুর, ইতালি, জর্ডান ও যুক্তরাজ্য অন্যতম। প্রথম পর্বের ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মো: হাবিবুল্লাহ রায়হান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বৃষ্টিতে দুর্ভোগ : কুমিল্লার সদর থেকে আসা মো. হান্নান মিয়া বলেন, আমাদের এলাকা থেকে মোট ১৬০ জন সাথী একসঙ্গে ইজতেমা ময়দানে আসছি। সকল সফর সঙ্গীর মাল-সামানা নিয়ে দুইদিন আগেই ৩৮নং খিত্তায় আছি। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বয়ান শুনছি। দুপুর থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে সন্ধ্যার পর থেকে বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে যায়, কিন্তু সকলেই একসঙ্গে রয়েছি। বৃষ্টি আসলেও বয়ান শোনা বন্ধ করছি না। বৃষ্টিও আল্লাহর রহমত।
আরেক মুসল্লি আবুল কালাম জানান, আজ ভোর থেকে কয়েক দফায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হলেও সন্ধ্যায় বৃষ্টির মাত্রা বেড়ে গেছে। দিনের বৃষ্টিতে মুসল্লিদের ভোগান্তি না হলেও সন্ধ্যার বৃষ্টিতে ভোগান্তি বেড়েছে।
দুর্ঘটনা: ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে এসে টঙ্গীতে সড়কে প্রাণ গেল পুলিশ অফিসারের
টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে এসে সড়ক দুর্ঘটনায় পুলিশের একজন এএসআই নিহত ও একজন এসআই গুরুতর আহত হয়েছেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত এএসআই এর নাম হাসানুজ্জামান (৩০)। একই দুর্ঘটনায় আহত এসআই আমীর হামজাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। তারা উভয়ে মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ থেকে ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলেন।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. ইব্রাহিম হোসেন জানান, উল্লিখিত দুই পুলিশ অফিসার টঙ্গী পূর্ব আরিচপুরস্থ অস্থায়ী আবাসস্থল থেকে মোটরসাইকেল যোগে ইজতেমায় তাদের দায়িত্ব পালনের নির্ধারিত স্থানে যাচ্ছিলেন। এএসআই হাসানুজ্জামান মোটর সাইকেল ড্রাইভ করছিলেন এবং তার পেছনে বসা ছিলেন এসআই আমীর হামলা। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী মিলগেট এলাকায় পৌছালে পেছন দিক থেকে দ্রুতগামীর একটি বাস মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই এএসআই হাসানুজ্জামান নিহত ও এসআই আমীর হামজা গুরুতর আহত হন। ভোরে সড়ক ফাঁকা থাকায় ঘাতক বাসটি সহজেই পালিয়ে যায়। বাসটিকে চিহ্নিত করে আটকের চেষ্টা চলছে বলেও জানান জিএমপির ওই কর্মকর্তা।
স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহন: ইজতেমা ময়দানে এসেছেন স্কুল মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও। ঢাকা জেলার ধামরাই থানার জামিয়া মোহাম্মদিয়া আরাবিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বলেন, মাওলানা ফজলুর রহমান হুজুরের সঙ্গে ২৩ জনের একটি জামাতে বৃহস্পতিবার ইজতেমা ময়দানে আসলাম। পাঁচ দিনের জামাতে আমরা এসেছি আল্লাহর দিদার লাভের আশায়। আমরা এই পাঁচ দিন বয়ান শুনব। বড় বড় হুজুরদের মুখে হাদিস ও কুরআনের কথা জানব। আল্লাহর রাস্তায় কাজ করতে আমরা এসেছি। নরসিংদী মাধবদী বড় মাদ্রাসার ছাত্র রাজ্জাক, ইউসুফ, আবির, আব্দুল্লাহ ও সাদেক জানান, তারা ইজতেমায় এসেছেন নিজেদের জন্য ও মা-বাবার জন্য দোয়া করতে। তাদের উদ্দেশ্য তারা যেন এখান থেকে দ্বীনি শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় নিজেদের পরিচালিত করতে পারেন।
গতকাল শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.ক.ম. মোজাম্মেল হক টঙ্গীর ইজতেমা মাঠ পরিদর্শন করেছেন। শুক্রবার দুপুরে তিনি ইজতেমা ময়দান পরিদর্শন করেন এবং বলেন, বাংলাদেশে ইজতেমার আয়োজন হচ্ছে। তাই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে হয়নি। আমরা আশা করি, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ব ইজতেমার দুটি পর্ব সমাপ্ত হবে। মন্ত্রী আরো বলেন, বিশ্ব ইজতেমা নির্বিঘ্ন করতে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মুসল্লিদের সেবা ও নিরাপত্তায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র্যাবসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর নিয়োজিত রয়েছে। এরপর মন্ত্রী বিদেশি খিত্তা পরিদর্শন করে বিদেশি মেহমানদের সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করেন।
চার জনের মৃত্যু : ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লাহ রায়হান জানান, বৃহস্পতিবার রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মো. এখলাছুর রহমান মারা যান। তার বাড়ি নেত্রকোণার বুরিজুরি এলাকায়।
এদিন দুপুরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ৭০ বছর বয়সী আব্দুস সাত্তার। তার বাড়িও নেত্রকোণার কুনিয়া কুমড়ি এলাকায়। এর পূর্বে ইজতেমায় আগত আরও দুই মুসল্লি মারা যান।
বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের আখেরী মোনাজাত ৪ ফেব্রæয়ারি। মাঝে চার দিন বিরতি পর ৯ ফেব্রæয়ারি দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে, ১১ ফেব্রæয়ারি আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।