টঙ্গী (গাজীপুর)প্রতিনিধি
টঙ্গীর তুরাগ তীরে দিল্লির মাওলানা ইলিয়াস বিন সাদ কান্ধলভী বয়ানের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ^ ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। ইলিয়ান বিন সাদ শুক্রবার ফজরের নামাজের পর উর্দুতে বয়ান শুরু করেন, যা বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মনির বিন ইউসুফ।
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে শুরুর দিন অনুষ্ঠিত জুমার জামাতেও অংশ নিয়েছেন লাখো মানুষ।শুক্রবার বেলা ১টায় ময়দানে জুমার আযান হয়। ১টা ৪৫ মিনিটে খুতবা শুরু হয়। নামাজে ইমামতি করেন মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী।
ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মুসল্লি ছাড়াও রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষ এই বৃহত্তম জুমার জামাতে শরিক হয়েছেন। শুক্রবার সকাল থেকেই সর্বস্তরের মুসলমানরা জুমার জামাতে শামিল হওয়ার জন্য টুপি, পাঞ্জাবী পরে জায়নামাজ হাতে ইজতেমা মাঠের দিকে ছুটতে দেখা গেছে। দেশ বিদেশের অগণিত মুসল্লির সঙ্গে একই জামাতে শরীক হয়ে নামাজ আদায় করার মাধ্যমে সাওয়াব হাসিলের উদ্দেশে সবার মধ্যে দেখা গেছে ব্যাকুলতা। যতই সময় গড়াতে থাকে ততই মুসল্লিদের ঢল আঁচড়ে পড়ে তুরাগ তীরে। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের সমাবেশ ঘটে জুমার জামাতে। জুমার জামাত শেষে তারা মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা করেন।
ইজতেমা মাঠে জুমার জামাত সুবিশাল প্যান্ডেলের গন্ডি ছাড়িয়ে বিস্তৃৃতি লাভ করে চারপাশের অলি-গলি ও রাস্তায়।ফলে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের পক্ষ থেকেও সড়কটি জুমার সময় বন্ধ রাখার কথা জানানো হয়। নামাজের পর যান চলাচল শুরু হয়। তবে মুসল্লিদের ভিড়ের কারণে খুবই ধীর গতিতে চলছে বাস-ট্রাকসহ অন্যান্য যানবাহন।
প্রথম পর্বের মতো দ্বিতীয় পর্বেও দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে অবস্থান নিয়েছেন। ১৬০ একর ময়দানে কিছু অংশ চটের প্যান্ডেল এবং ময়দানের বাকি অংশ ইজতেমায় যোগ দিতে আসা মুসল্লিরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সামিয়ানা টানিয়েছেন। তবে বিদেশি মেহমানদের জন্য টিন দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক সুবিধাসহ আবাসস্থল।
শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ৫৪টি দেশের ৬ হাজার ১২৬ জন বিদেশি মেহমান ময়দানে এসে উপস্থিত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আয়োজক কমিটি।ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে অনুকূল আবহাওয়া ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকায় ইজতেমায় আগত মুসল্লিগণ স্বাচ্ছন্দ্যে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের বয়ান শুনছেন এবং ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল রয়েছেন।
বাদ জুমা আরবি ভাষায় বয়ান করেন শেখ মোফলে। তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করবেন শেখ আব্দুল্লাহ মনসুর। বাদ আসর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোশাররফ হোসেন। বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা জিয়া বিন কাশেম। মাওলানারা তাবলীগ জামাতের ৬উসুল নিয়ে বিস্তারিত বয়ান করছেন এবং উপস্থিত সাধারন মুসল্লিদের তাবলীগের কাজে বের হবার আহবান জানাচ্ছেন।
এ ছাড়া জুমার নামাজের আগে বিদেশিদের খিত্তায় যান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লা খান, মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান সরকার রাসেল।তারা বিদেশি মেহমানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন ও সুবিধা-অসুবিধার খোঁজখবর নেন। পরে তারা ইজতেমা ময়দানে জুমার নামাজে শরিক হন।
এর মধ্যে শুক্রবার সকালেই ইজতেমা ময়দানে আসেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল। তিনি বিদেশিদের খিত্তায় খিত্তায় গিয়ে মেহমানদের খোঁজখবর নেন এবং তাদের সব ধরনের সেবা প্রদানের আশ্বাস দেন। জাহিদ আহসান রাসেল জানান, প্রতি বছরই ইজতেমায় আগত মানুষদের বিভিন্ন সমস্যা ও সেবার জন্য ইজতেমার ময়দানে আসেন। দুইপর্বের জন্য তিনদিন ময়দানে নেতাকর্মীদের নিয়ে সেবায় নিয়োজিত থাকেন।তিনি আরও জানান, অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছর ইজতেমায় পানির ব্যবস্থা, টয়লেটখানা, গ্যাস ব্যবস্থা, ফায়ার সার্ভিস, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে।
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বে যোগ দিয়েছেন যারা : বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে এসেছেন মালয়েশিয়ায় ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’ বলে খ্যাত আলোচিত সমাজকর্মী ইবিট লিও ও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম। এ সময় ময়দান থেকে অভ্যর্থনা জানান কাকরাইল মসজিদের শুরা সদস্য মাওলানা ওয়াসিফুল ইসলামের ছেলে মুফতি ওসামা ইসলাম ও মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম।
দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় ৪ মুসল্লির মৃত্যু: বিশ^ ইজতেমায় শুক্রবার বিকেল বিকেল পর্যন্ত ৪ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ থানার শিবনগর গ্রামের মৃত ইউসুফ উদ্দিনের ছেলে মোহাম্মদ জহির উদ্দিন (৭০), জামালপুর জেলার ইসলামপুর থানার গোয়ালের গ্রামের ছবির উদ্দিনের ছেলে নবীর উদ্দিন (৬৫), শেরপুর জেলা সদরের মৃত মহেজদ্দিনের ছেলে আবুল কালাম (৬৫) ও নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার কুতুবপুর গ্রামের মৃতু সুলতানের ছেলে আব্দুল হেলিম (৬২)। তাদের বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম।
তাবলিগ জামাতের সর্ববৃহৎ এ জমায়েত ঘিরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মাহবুব আলম গতকাল শুক্রবার বলেন, এবার মুসুল্লিদের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন সার্বক্ষণিক মুসুল্লিদের পাশে আছে। জিএমপি কমিশনার বলেন, ইজতেমা মাঠে লাখ লাখ মানুষের সমাগম হয়েছে। তাদের সেবায় পুলিশ প্রশাসন পাশে আছে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলাসহ সবকিছু এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে। এরিয়াটা নিরাপত্তার চাদরে যেহেতু ঢেকে দিয়েছি, সুতরাং কোনোরকম কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না।
ইজতেমায় আগত মুসল্লিরা ডায়ারিয়া, আমাশয়, শ^াসকষ্টজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ইজতেমা ময়দানে হামদর্দ ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, এখন পর্যন্ত ইজতেমায় আসা প্রায় দুই হাজার মানুষকে তারা চিকিৎসা দিয়েছেন। তাদের অধিকাংশই ডায়রিয়া, অ্যাজমা ও জ্বরে আক্রান্ত।
টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের কর্মকর্তা বলেন, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ইজতেমায় আসা ১ হাজার জন তার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
আগামী রোববার (১১ ফেব্রেæয়ারি) সকালে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব।