প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যেসব দেশ মানবাধিকার বিষয়ে সবক দেয় বা প্রশ্ন তোলে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারাই বঙ্গবন্ধু ও নারী-শিশুসহ তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যাকারীদের আশ্রয় দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে এদের কাছ থেকে মানবাধিকারের সবক নিতে হয়। যারা আমার বাবা, মা, ভাই, নারী-শিশুদেরকে হত্যা করেছে তাদেরকে তারা রক্ষা করে।’
মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতির পিতার ৪৭তম শাহাদতবার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্মরণসভায় সভাপতির ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘এই খুনি রাশেদ ছিল কমান্ডিং অফিসার, আমেরিকার সঙ্গে বার বার কথা বলেছি তাকে তারা দিচ্ছে না। তাকে তারা লালন-পালন করে রেখে দিচ্ছে। আর নূর আছে কানাডায়।’
তিনি পলাতক খুনীদের অবস্থান সম্পর্কে বলেন, রশিদ লিবিয়াতে পড়ে থাকে মাঝে মাঝে পাকিস্তানে যায়। ডালিম আছে লাহোরে এইটুকু জানি। খুব বেশি খবর পাওয়া যাচ্ছে না। মোসলেহ উদ্দিন নাম-ধাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন সময়ে অবস্থান বদল করে বিভিন্ন স্থানে গা ঢাকা দিয়ে আছে। হুদাকে সে দেশের সরকারের সহযোগিতায় থাইল্যান্ড থেকে এবং মহিউদ্দিনকে দেশে এনে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামির মধ্যে ফারুকসহ ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে এই ৪৭ বছরে। তাহলে তার এবং পরিবারের ভাগ্যহতদের মানবাধিকার কোথায় সে প্রশ্নও তোলেন।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সূচনা বক্তৃতা করেন। দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বর্ষীয়ান নেতা আমি হোসের আমু ও তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান ও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, দলের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, মহানগর উত্তর সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও দক্ষিণ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মান্নাফী। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ সভা সঞ্চালনা করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ’৭৫ এর ১৫ আগষ্টের সকল শহীদ স্মরণে সকলে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজ অনেকেই সোচ্চার হন, মানবাধিকারের কথা বলা হয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন আসে, আমাদের সরকারকে অনেকে মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করেন। যারা এই প্রশ্ন করেন তাদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা ১৫ আগস্ট আমরা যারা আপনজন হারিয়েছি তাদের মানবাধিকার কোথায় ছিল? আমাদেরতো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। আমরা যারা মা-বাবা হারিয়েছি তারা মামলা করতে পারব না। বিচার চাইতে পারব না, কেন? আমরা এ দেশের নাগরিক নই? উল্টো খুনিদের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে দায়মুক্তির পাশাপাশি বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে জিয়াউর রহমান পুরস্কৃত করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তোলেন জিয়াউর রহমান যদি খুনি বা ষড়যন্ত্রকারী না হন তাহলে খুনি মোশতাক তাকে সেনাপ্রধান করবে কেন? আর সেই বা এই খুনিদের পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে অনুরোধ করে তাকে দিয়ে লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফিকে অনুরোধ করিয়ে সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেবে কেন? পরবর্তীতে তাদের আবার বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
খুনিদের আশ্রয়-প্রশয়ের বিষয়ে তিনি ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, তিনি খুনি পাশা এবং হুদাকে নিয়ে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়েছিলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় এসে খুনি ফারুককে দিয়ে ফ্রিডম পার্টি গঠন করায়। খালেদা জিয়া আরো একধাপ উপরে উঠে খুনি ফরুক, রশিদ এবং হুদাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী করে। ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে হুদাকে চুয়াডাঙ্গা থেকে এবং রশিদকে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত ঘোষণা করে সংসদে বিরোধী দলের নেতা বানায়। কাজেই তারা কিভাবে অস্বীকার করবে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তারা জড়িত নয়?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপিতো এদের মদতদাতা। এদের লালন পালনকারী। ’৯৬ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন জনগণ মেনে না নিলে গণআন্দোলনের মুখে ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় সেই নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গেলেও সেই বাঁচা ছিল যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা বলেন জাতির পিতার কন্যা।
শেখ হাসিনা বলেন, ’৯৬ সালে যদি তিনি সরকারে আসতে না পারতেন, ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করতে না পারতেন তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কোনোদিন হত না। তারপরেও ’৯৮ সালে যেদিন জাতির পিতা হত্যা মামলার বিচারের রায় হবার কথা সেদিনও হরতাল ডেকেছিল বিএনপি, খুনিদের বাঁচাতে। আর ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই খালেদা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন এই মামলার সব বিচারকার্য বন্ধ করে দেয়।
বেঁচে থাকলে সকলেই পাশে থাকে আর মরে গেলে যে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না তার প্রমাণ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের ওই বাড়িটিতে মৃতদেহগুলো পরদিন পর্যন্ত পড়ছিল বলেও তিনি জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব সহ্য করে নীলকণ্ঠ হয়ে শুধু অপেক্ষায় থেকেছি কবে ক্ষমতায় যেতে পারব আর এই দেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাব। আর তাহলেই এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত প্রতিশোধ নেয়া হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই শোক সভায় আজকে আমরা এই প্রতিজ্ঞাই নেব- জাতির পিতার যে আদর্শ সেই আদর্শকে ধারণ করে এই দেশকে আমরা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব।
তিনি বলেন, জাতির পিতা এদেশের মানুষর জন্য জন্য রক্ত দিয়ে গেছেন। রক্ত দিয়ে গেছেন আমার মা, ভাইয়েরা সে কথা আমি ভুলতে পারি না। সেই মানুষগুলোর পাশে থাকা কর্তব্য বলে মনে করি। এখানে কোন মানুষ কষ্ট পাক আমরা তা চাই না।
তিনি বলেন, ‘যে নাম ঘাতকের দল মুছে ফেলতে চেয়েছিল আজ আর সেই নাম মুছতে পারবে না। আজকে বিশ্বব্যাপী সে নাম সমাদৃত। সেই জয় বাংলা স্লোগান আবার ফিরে এসেছে। ৭ মার্চের ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। বিকৃত ইতিহাস নয়, আজকে সঠিক ইতিহাস মানুষ জানতে পারছে। বিশ্ব দরবারে আজ আমরা মাথা উঁচু করে চলতে পারছি, মাথা উঁচু করেই চলবো। কিন্তু এই দুঃসময়ে দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে যার যেটুকু সামর্থ সে অনুযায়ী মানুষের সেবা করতে হবে।’
তিনি সমাজের বিত্তবানদের সাধারণ দুঃস্থ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। সরকার যথাসাধ্য করবে এবং তিনি তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের এ সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার তালিকা করে সকল ভূমিহীন-গৃহহীনকে ঘর করে দিচ্ছে। কিন্তু এর বাইরেও যদি কেউ কারো এলাকায় থাকেন তাহলে সে ব্যাপারে তার সরকারকে জানালে তাদেরকে গৃহনির্মাণ করে দেয়া হবে। কেননা সরকার চায় দেশে আর কোন মানুষ গৃহহীন থাকবে না।
তিনি এ সময় কোথাও এতটুকু জমিও অনাবাদি না রেখে তাকে উৎপাদনের আওতায় আনার মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের তার আহ্বান পুণর্ব্যক্ত করে বলেন, তার একটাই লক্ষ্য জাতির পিতা স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলা। যে লক্ষ্য অর্জনের পথে তার সরকার অনেকদূর এগিয়েছে, ইনশাল্লাহ এই যাত্রা আর কেউ থামাতে পারবে না।