টঙ্গী (গাজীপুর)প্রতিনিধি
নিজের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসা ও স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখা অবস্থায় মিললো প্রধান শিক্ষককের লাশ। পেছনের সিটেই বসা অবস্থায় পাওয়া যায় তার স্ত্রীর লাশও। গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীর শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জিয়াউর রহমান মামুন (৫০) ও তার স্ত্রী টঙ্গী আমজাদ আলী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এÐ কলেজের সহকারী শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার জলির (৩৫) লাশ বৃহস্পতিবার ভোরে তাদের গাড়ির ভেতর এভাবেই পাওয়া যায়। এর আগে বুধবার রাত পৌনে ৭টা থেকে তারা নিখোঁজ হন। বহু খোঁজাখুঁজির পর বৃহস্পতিবার ভোরে গাজীপুর মহানগরীর ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের জয় বাংলা সড়কের বগারটেক এলাকায় মেসার্স লিমন ব্রাদার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে তাদের গাড়ির সন্ধান পান স্বজনরা। গাড়ির ভেতর থেকে তাদের নিথর দেহ উদ্ধার করে স্থানীয় একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও রাজধানীর উত্তরার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এর পর স্বজনরা লাশ দুটি অ্যাম্বুলেন্সে করে জিএমপির গাছা থানায় নেন। সেখানে সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত শেষে ময়না তদন্তের জন্য লাশ দুটি গাজীপুর শহীদ তাজ উদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। এঘটনায় এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় চলছে। তাদের মৃত্যু রহস্য উদঘাটনে মাঠে নেমেছে পিবিআই, সিআইডিসহ পুলিশের বিভিন্ন গোয়েন্দা ইউনিট। তবে তাদের স্বজনদের অভিযোগ, এটি সম্পূর্ণ পরিকল্পিত হত্যাকাÐ।
নিহত জিয়াউর রহমানের ছোট ভাই একেএম জিয়াউল হক বলেন, এটি পুরোপুরি পরিকল্পিত হত্যাকাÐ। তাদের সঙ্গে থাকা স্বর্ণালংকার, দেড় লক্ষাধিক নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন সবই অক্ষত ছিল। যদি ছিনতাইকারী কিংবা দুর্বৃত্তরা এ ঘটনা ঘটাতো তাহলে টাকা, স্বর্ণ, মোবাইলসহ সব কিছু লুটে নিত। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটেনি। শুধু তাজা দু’টি প্রাণ নিয়ে গেছে। তবে কেন এবং কারা এ হত্যাকাÐ ঘটাতে পারে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ভাইয়ের প্রকাশ্য কোনো শত্রæ নেই। তার কোনো অপ্রকাশ্য শত্রæ সম্পর্কেও আমাদের জানা নেই। কারোর সাথে তার কোনো বিরোধও ছিল না।
টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক নূরুজ্জামান রানা জানান, নিহত জিয়াউর রহমানের সহধর্মিনী টঙ্গী আমজাদ আলী পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এÐ কলেজের সহকারী শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার জলি বুধবার বিকেল ৪টায় শহিদ স্মৃতি স্কুলে যান। পরে সন্ধ্যা ৬টা ২০ মিনিটে তারা নগরীর গাছা থানাধীন কামারজুরির বাড়ির উদ্দেশ্যে নিজস্ব গাড়ি নিয়ে স্কুল থেকে রওনা হন। পরে রাতে তাদের নিখোঁজ হওয়ার খবর পান।
নিহত শিক্ষক জিয়াউর রহমানের ছেলে একেএম তৌসিফুর রহমান মিরাজ বলেন, বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে বাবার মোবাইলে ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে মায়ের মোবাইলে ফোন দিলে রিসিভ হয়। এসময় মায়ের কন্ঠ ভার ছিল। পরবর্তীতে মা-বাবার কারোর ফোন রিসিভ না হওয়ায় রাতে আত্মীয় স্বজনদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেন। ভোররাত ৪টার দিকে গাছা থানার জয়বাংলা সড়কে দক্ষিণ খাইলকুর বগারটেক নামক স্থানে তাদের প্রাইভেটকার দেখতে পেয়ে কাছে যান। এসময় চালকের আসনে বাবা ও পাশেই পেছনের সিটে মাকে নিস্তেজ অবস্থায় পেয়ে প্রথমে তায়রুন্নেছা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এরপর দুটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাদের লাশ গাছা থানায় আনা হয়।
নিহত জিয়াউর রহমানের ভগ্নিপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরে টঙ্গীর শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন জিয়াউর রহমান। পরে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার জলিও স্থানীয় আমজাদ আলী সরকার পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এÐ কলেজের সহকারী শিক্ষিকা। তারা সপরিবারে গাছা থানার কামারজুরি এলাকায় নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। ব্যক্তিগত গাড়িতে করে তারা দুজনই স্কুলে যাওয়া আসা করতেন।
লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী গাছা থানার এসআই নাদিরুজ্জামান বলেন, নিহত দম্পতির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে শিক্ষিকা জলির নাক দিয়ে ফেনা বের হতে দেখা গেছে।
এদিকে সিআইডি’র ক্রাইম সিন ইউনিটের সদস্যরা ও পিবিআই সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সিআইডি সদস্যরা গাড়ি থেকে খাবারের প্যাকেট, টিফিন ক্যারিয়ারে খাবারের উচ্ছি¡ষ্টসহ বেশ কিছু আলামত সংগ্রহ করেছেন। খাবারের সাথে বিষ মিশিয়ে তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে বলে স্বজনদের দাবি।
নিহত জিয়াউর রহমানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী সাজেদা বেগম জানান, জিয়াউর রহমানের প্রথম স্ত্রী প্রায় আট বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এর পর তিনি শিক্ষিকা মাহমুদা আক্তার জলিকে বিবাহ করেন। এই শিক্ষক দম্পতির কোনো সন্তান নেই। জিয়াউর রহমানের আগের সংসারের একমাত্র ছেলে তৌসিফুর রহমান মিরাজ সাভার মির্জা নগরে গণস্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
নিহত জিয়াউর রহমানের বড় ভাই মো. রিপন জানান, ময়না তদন্ত শেষে টঙ্গী শহিদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রথম নামাজে জানাযা ও পরে নগরীর ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের কামারজুরি এলাকায় দ্বিতীয় নামাজে জানাযা শেষে লাশ দুটি তাদের ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার দড়ি কাঠাল গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হবে।
এব্যাপারে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের দক্ষিণ বিভাগের উপ-কমিশনার (অপরাধ) মোহাম্মদ ইলতুৎমিশ বলেন, সুরতহাল শেষে ময়না তদন্তের জন্য লাশ মর্গে পাঠানো হয়েছে। ঘটনা তদন্তে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিষয়টি পরিকল্পিত হত্যাকাÐ কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তাৎক্ষণিভাবে এর বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না। মামলা প্রক্রিয়াধীনে আছে।