সন্ধ্যায় সর্বস্তরের শ্রদ্ধার জন্য বরেণ্য অভিনেতা-নাট্যকার ড. ইনামুল হকের মরদেহ নেয়া হয়েছে রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে। এ সময় প্রখ্যাত এ নাট্যজনকে এক নজর দেখতে ছুটে আসেন সতীর্থ ও নাট্যকর্মীরা। চোখের জল ও শ্রদ্ধায় শেষ বিদায় জানান প্রিয় নাট্যজনকে।
সেখানে জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়া স্ত্রী নাট্যজন লাকী ইনামও উপস্থিত ছিলেন। স্বামীর মরদেহ সামনে রেখে চোখের জলে তিনিও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
সংস্কৃতি অঙ্গনে ড. ইনামুল হকের অবদান সরণ করে আবেগঘন বক্তব্য দেন লাকী ইনাম। এ সময তিনি বলেন, আমার বুঝতে পারছি না উনি ছাড়া কিভাবে বাকি জীবনটা কাটাবো, থিয়েটার করবো? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না এই মানুষটি চলে গেছে। এত দেশপ্রেমী, এত মানবপ্রেমী, সবাইকে ভালোবাসতেন। কেউ তার সামনে বদনাম করতে পারতো না, বলতেন, ‘তোমরা হয়তো জানো না তার গুণ কোথায়’। থিয়েটারের ছেলে মেয়েরা তার প্রাণ ছিলো। তাকে ছাড়া আমি একা একা কী করে থিয়েটার করবো, আমার সংগ্রাম কী করে চালাবো আমি জানি না। আমি জানি আমার সব কাজে আমি তোমাকে পাশে পাবো, পাশে পাবো তোমাকে। তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না, কক্ষণো না।’
শোকসভায় বক্তব্য রাখেন নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকিসহ অনেকে।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, আগামীকাল (১২ অক্টোবর) সর্বস্তরের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে ড. ইনামুল হকের মরদেহ। সকাল সাড়ে ১০টায় সেখানে তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হবে। এরপর বেলা ১২টায় ইনামুল হককে নেওয়া হবে তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল বুয়েটে। সেখানে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে বাদ জোহর তাকে সমাহিত করা হবে।
সোমবার বিকালে রাজধানীর বেইলি রোডের নিজ বাসায় মারা গেছেন ড. ইনামুল হক। বর্ষিয়ান এই নাট্যজনের চির বিদায়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সংস্কৃতি অঙ্গনে।
জীবন প্রায় পুরোটা সময় নাটকের সঙ্গেই থেকেচেন তিনি। ছাত্র অবস্থায় নটরডেম কলেজে পড়াশোনাকালীন প্রথম মঞ্চে আগমন ঘটে তার। ফাদার গাঙ্গুলীর নির্দেশনায় তখন তিনি ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। দলটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন ড. ইনামুল হক। এই দলের হয়ে প্রথম তিনি মঞ্চে অভিনয় করেন আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ নাটকে।
এরপর এই দলের হয়ে ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘নূরুল দীনের সারা জীবন’সহ আরো বহু নাটকে অভিনয় করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি এই দল থেকে বের হয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’। সর্বশেষ দলটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন গুণী এই নাট্যজন।
নাট্যাঙ্গনে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি দীর্ঘ ৪৩ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থাকার সময় ১৫ বছর রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান এবং দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ইনামুল হকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৯ মে ফেনী সদর উপজেলার মোটবী ইউনিয়নে। তার বাবা ওবায়দুল হক ও মা রাজিয়া খাতুন।
ড. ইনামুল হকের পুরো পরিবারই বাংলা নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তার দাম্পত্য সঙ্গী নাট্যজন লাকী ইনাম। তাদের সংসারে দুই মেয়ে হৃদি হক আর প্রৈতি হক। দুই জামাতা অভিনেতা লিটু আনাম ও সাজু খাদেম।
ফেনী পাইলট হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকার নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগ থেকে তিনি বিএসসি ও এমএসসি সম্পন্ন করেন। পরে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি লাভ করেন।