যমুনা নদীর বঙ্গবন্ধু সেতু এবং ধলেশ্বরী নদীর মুক্তারপুর সেতুতে টোল বেড়েছে। মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সেতু বিভাগ। সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) জানায়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেটাতে এবং সেতু নির্মাণে নেওয়া বৈদেশিক ঋণ শোধে দশ বছর পর ১৭ শতাংশ টোল বাড়নো হয়েছে। সফটওয়্যার হালনাগাদের পর আগামী দুই এক দিনের মধ্যে বর্ধিত টোল আদায় শুরু হবে সেতুতে চলাচল করা যানবাহন থেকে।
সেতু কর্তৃপক্ষ ১৭ শতাংশ টোল বৃদ্ধির কথা বললেও বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, বড় পণ্যবাহী যানবাহনে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়েছে। পরিবহন মালিক শ্রমিকরা বলেছেন, আলোচনা ছাড়াই সরকার টোল বাড়িয়েছে। টোল বাড়ায় পণ্যপরিবহনে ভাড়া বাড়বে, দ্রব্যমূল্য বাড়বে। তারা টোল বৃদ্ধিতে নাখোশ।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে তিন এক্সেলের বড় ট্রাকের টোল ৪৩ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ৪০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে চার এক্সেলের ট্রেইলারেও এক হাজার ৪০০ টাকা টোল নেওয়া হয়। নতুন টোল হার অনুযায়ী- ট্রেইলারকে পৃথক শ্রেণির যান হিসেবে নির্ধারণ করায় তিন হাজার টোল দিতে হবে প্রতিবার বঙ্গবন্ধু সেতু পার হতে।
বাড়তি প্রতি এক্সেলের জন্য এক হাজার টাকা করে টোল দিতে হবে। পণ্য পরিবহনে সর্বোচ্চ ছয় এক্সেলের প্রাইম মুভার চলাচল করে। এ গাড়িতে টোল দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এখন দিতে হয় এক হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চলাচলের বার্ষিক টোল ৫০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা হয়েছে।
যাত্রীবাহী যানবহনে টোল তুলনামূলক কম বেড়েছে। বঙ্গবন্ধু সেতুতে সাইকেলের টোল ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা, কার ও জিপে ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৫৫০ টাকা করা হয়েছে। বর্তমানে মাইক্রোবাস ও পিকাআপেও টোল ৫০০ টাকা। তা বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা। ৩২ আসনের কম অর্থাৎ ছোট বাসের টোল ৬৫০ থেকে বাড়িয়ে ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। বড় বাসে টোল ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতুতে। বড় ও ছোট বাসে যাত্রীপ্রতি তিন থেকে চার টাকা ভাড়া বাড়বে।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে ছোট, মাঝারি ও বড়- এই তিন ক্যাটাগরিতে ট্রাকের টোল নেওয়া হয়। নতুন নিয়মে ক্যাটাগরি চারটি করা হয়েছে। পাঁচ টনের কম অর্থাৎ ছোট ট্রাকে টোল ৮৫০ থেকে বাড়িয়ে এক হাজার করা হয়েছে। পাঁচ থেকে আট টনের ট্রাকে ৮৫০ টাকার টোল ৪৭ শতাংশ বাড়িয়ে এক হাজার ২৫০ টাকা হয়েছে। আট থেকে ১১ টনের ট্রাকের টোল ৪৫ শতাংশ বেড়েছে। এক হাজার ১০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে।
এক হাজার ৫২১ মিটার দীর্ঘ মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুতে তিন চাকার গাড়ি ও মোটরসাইকেলের টোল ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা, অটোরিকশায় ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা, কার ও মাইক্রোবাসে ৪০ থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা, ছোট বাসে ১০০ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা, বড় বাসে ২০০ থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।
২০০৮ সালে নির্মিত মুক্তারপুর সেতুতেও যাত্রীবাহীর তুলনায় পণ্যবাহী গাড়িতে টোল বেশি বেড়েছে। ছোট ট্রাকে ১৫০ টাকার টোল ৫০ বাড়লেও আট থেকে ১১ টনের ট্রাকের টোল তিনগুণ বেড়েছে। ২০০ থেকে ৬০০ টাকা হয়েছে। বড় ট্রাকে ৬০ শতাংশ টোল বেড়েছে। ৫০০ টাকার টোল ৮০০ টাকা হয়েছে।
এ সেতুতেও ট্রেইলার, কভার্ড ভ্যান, প্রাইম মুভারের মতো বড় পণ্যবাহী গাড়িতে বড় ট্রাকের হিসাবে টোল নেওয়া হয়। চার এক্সেলের ট্রেইলারে এক হাজার টাকা টোল দিতে হবে। এখন দিতে হয় ৫০০ টাকা। মুক্তারপুর সেতুতে বাড়তি প্রতি এক্সেলের জন্য বাড়তি ৫০০ টাকা করে দিতে হবে। ছয় এক্সেলের গাড়িকে দুই হাজার টোল দিতে হবে।
ট্রাক কভার্ড ভ্যান প্রাইম মুভার পণ্যবাহী মালিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মকবুল আহমেদ বলেছেন, সরকার তাদের অবগত না করে টোল বাড়িয়েছে। উত্তরবঙ্গ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার কৃষিপণ্যাহী প্রাইম মুভার, ট্রাক, ট্রেইলার সারাদেশে যায় বঙ্গবন্ধু সেতু হয়েছে। টোল বাড়ায় গাড়ির ভাড়া বাড়বে। এতে খাদ্যপণ্য ও দ্রব্যমূল্য বাড়বে।
ট্রাক কভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী বলেছেন, টোল বৃদ্ধির বিষয়ে কী করা যায় তার মালিক সংগঠনগুলোর আলোচনা ঠিক হবে।
সেতু সচিব তথা সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু সেতুতে সর্বশেষ ২০১১ সালে ১৭ শতাংশ টোল বাড়ানো হয়েছিল। দ্রব্যমূল্য ও জনগণের কথা চিন্তা করেই ১০ বছর পর মাত্র ১৭ শতাংশ টোল বাড়ানো হয়েছে। আরও আগেই টোল বাড়ত। করোনার কারণে এক বছর পর বাড়ানো হয়েছে। মুক্তারপুর সেতুতে ১৩ বছরে প্রথম টোল বাড়ছে। নতুন হারে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে ট্রাককে। ট্রেইলারকে আলাদা শ্রেণি করা হয়েছে। এ কারণে মনে হচ্ছে টোল অনেক বেড়েছে।’
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘অবিলম্বে বর্ধিত টোল হার কার্যকর হবে।’ কবে থেকে বাড়বে টোল- এ প্রশ্নে সচিব আবু বকর বলেছেন, দুই সেতুতে টোল পদ্ধতি কম্পিউটার বেইজড। সফটওয়্যার হালনাগাদের কাজ চলছে। তা শেষ হলে বুধবার কিংবা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২টা থেকে বর্ধিত টোল আদায় শুরু হবে।
গত ২৪ জুন সেতু কর্তৃপক্ষের ১১০তম বোর্ড সভায় টোল বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুর টোল হারও নির্ধারণ করা হয় বোর্ড সভায়। তবে তা এখনও সরকারের অনুমোদন পায়নি। দেড় কিলোমিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে সেতু বিভাগ। এর চেয়ে ছোট সেতুর দায়িত্ব সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ)। টোল আদায় বন্ধে বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই আন্দোলন হয়। ঢাকার পোস্তাগোলা সেতুতে টোল বন্ধের দাবিতে আন্দোলনে প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটেছে।
১৯৯৭ সাল থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু সেতুতে। তিন হাজার ৭৪৫ কোটি ব্যয়ে নির্মিত এই সেতু থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা টোল আদায় করেছে সরকার। করোনায় লকডাউনে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ৬৫৪ কোটি টাকা টোল আদায় হয়। ২০৮ কোটি টাকায় নির্মিত মুক্তারপুর সেতু থেকে ১৩ বছরে টোল আদায় হয়েছে ১৬৭ কোটি টাকা।
নির্মাণ ব্যয়ের দ্বিগুণ আদায় হলেও চার দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের ঋণ পরিশোধ শেষ হয়নি। রক্ষণাবেক্ষণ ও সেতু কর্তৃপক্ষের ব্যয় নির্বাহে বড় টাকা যাচ্ছে। সংসদে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ২০৩৪ সাল নাগাদ ঋণ শোধ হবে।