চাহিদার চেয়ে উৎপাদন ক্ষমতা বেশি থাকা, সরকারের উচ্চ মূল্যে কেনা ও প্রতিযোগিতার অভাবে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। সমঝোতা ছাড়া দরপত্রের মাধ্যমে চুক্তি হলে কম দামে বিদ্যুৎ পেত সরকার। এসব ভুল নীতির কারণে উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ভর্তুকি বেড়েছে। এর দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ওপর। বিদ্যুতের দাম দফায় দফায় বাড়ানোয় এর প্রভাবে ঘটেছে মূল্যস্ফীতি। বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়।
এসব কথা বলা হয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা প্রতিবেদনে। গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, এর প্রভাব, বিকল্প উপায় ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
মোয়াজ্জেম বলেন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে পাশ কাটিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে মূল্য বৃদ্ধির কারণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জায়গাগুলো আস্তে আস্তে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক। ক্যাপাসিটি চার্জের পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে– উচ্চ মূল্যের বিদ্যুৎ কেনা, এলএনজি ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝোঁক এবং বিদ্যুৎ কেনায় প্রতিযোগিতার অভাব। বিশেষ ক্ষমতা আইনে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তির কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।
সিপিডিরি গবেষণায় দেখা গেছে, বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে, গ্রাহক সে হারে বাড়েনি। ২০১৫-১৬ সালে উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে ১৩ শতাংশ, গ্রাহক বেড়েছে ৯.৫১ শতাংশ। ২০১৮-১৯ সালে বিদ্যুতের নতুন উৎপাদন সক্ষমতা ১৮.৮৬ শতাংশ বৃদ্ধির বিপরীতে গ্রাহক বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৭২ শতাংশ। ২০২১-২২-এ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে ১৬.০৪ শতাংশ, বিপরীতে গ্রাহক বেড়েছে ৬.৩৫ শতাংশ।
অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতার কারণে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয় সরকারকে। এতে বেড়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়। ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়াও জ্বালানির খরচ বৃদ্ধির কারণেও খরচ বেড়েছে। ২০২০ সালেও ৫৪ শতাংশ বিদ্যুৎ গ্যাস ব্যবহারে উৎপাদন হতো, তা এখন কমে হয়েছে ৪৫.৬ শতাংশ। তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ বেশি উৎপাদন হয়েছে, যা ব্যয়বহুল। পাশাপাশি আমদানি করা এলএনজির ব্যবহারের কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে বলে সিপিডিরি গবেষণায় বলা হয়েছে।
২০১৯-২০ সালে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ছিল ৫.৯১ টাকা। ২০২২-২৩-এ তা বেড়ে হয়েছে ১১.৩৩ টাকা। ২০২০-২১-এ বিদ্যুতে ভর্তুকি ছিল ৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভর্তুকি বেড়ে হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক মোয়াজ্জেম বলেন, সর্বশেষ বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রতি পরিবারে মাসিক ব্যয় গড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র শিল্পে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ, ব্যবসা ও অফিসে ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ, শিল্পে ১০ শতাংশ এবং সেচে ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বিদ্যুৎ বিল বেড়েছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও এর সঙ্গে বেড়েছে।
বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের ভোক্তার ওপর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি অভিঘাত পরিলক্ষিত হয়েছে। আগামী দিনেও এই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ভর্তুকি সমন্বয়ের বিকল্প প্রস্তাবনার বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চারটি কৌশলের মাধ্যমে সরকার ভর্তুকি সমন্বয় করতে পারে। প্রথমত, নতুন যে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে, সেগুলোতে ‘নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পে’, পুরোনোগুলোর চুক্তি শেষ হওয়ার পরে সেগুলো সব নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পে– এভাবে চুক্তি করতে হবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির খুব কম অংশ ভোক্তার ওপরে দেওয়া যেতে পারে। ধারাবাহিকভাবে বন্ধ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে বদলাতে হবে। এই চারটি বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে যদি সরকার তার পরিকল্পনা ঘোষণা করে, তাহলে ২০২৯ সালের মধ্যে সরকারকে আর ভর্তুকি দিতে হবে না।
from samakal